মায়ের বুকের দুধ যে শিশুর বৃদ্ধি আর পুষ্টির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ কথা সবারই যানা। কিন্তু আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগের কোন গ্রন্থে যদি বার বার শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য উৎসাহিত করা হয় তাহলে কিন্তু অবাকই হতে হয়। আর সেই গ্রন্থটা ডাক্তারী কোন বই না হয়ে যদি একটা ধর্মগ্রন্থ হয় তাহলে কিন্তু বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। হ্যাঁ, সেই মহাগ্রন্থটাই হচ্ছে আল-কোরান। যেখানে একটি-দুটি নয় বরং প্রায় ৪ টি আয়াতে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে বলা হয়েছে। এবং শিশুকে কতদিন এবং কিভাবে বুকের দুধ দিতে হবে সেটিও যানিয়ে দেয়া হয়েছে।
বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে কোরানের প্রথম আয়াতটি হচ্ছে সূরা বাকারার ২৩৩নং আয়াত-
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلاَدَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَن يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ وَعلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ لاَ تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلاَّ وُسْعَهَا لاَ تُضَآرَّ وَالِدَةٌ بِوَلَدِهَا وَلاَ مَوْلُودٌ لَّهُ بِوَلَدِهِ وَعَلَى الْوَارِثِ مِثْلُ ذَلِكَ فَإِنْ أَرَادَا فِصَالاً عَن تَرَاضٍ مِّنْهُمَا وَتَشَاوُرٍ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْهِمَا وَإِنْ أَرَدتُّمْ أَن تَسْتَرْضِعُواْ أَوْلاَدَكُمْ فَلاَ جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِذَا سَلَّمْتُم مَّا آتَيْتُم بِالْمَعْرُوفِ وَاتَّقُواْ اللّهَ وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ
আর সন্তানবতী নারীরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ন দু‘বছর দুধ খাওয়াবে, যদি দুধ খাওয়াবার পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়। আর সন্তানের অধিকারী অর্থাৎ, পিতার উপর হলো সে সমস্ত নারীর খোর-পোষের দায়িত্ব প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী। কাউকে তার সামর্থাতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন করা হয় না। আর মাকে তার সন্তানের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এবং যার সন্তান তাকেও তার সন্তানের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন করা যাবে না। আর ওয়ারিসদের উপরও দায়িত্ব এই। তারপর যদি পিতা-মাতা ইচ্ছা করে, তাহলে দু’বছরের ভিতরেই নিজেদের পারস্পরিক পরামর্শক্রমে দুধ ছাড়িয়ে দিতে পারে, তাতে তাদের কোন পাপ নেই, আর যদি তোমরা কোন ধাত্রীর দ্বারা নিজের সন্তানদেরকে দুধ খাওয়াতে চাও, তাহলে যদি তোমরা সাব্যস্তকৃত প্রচলিত বিনিময় দিয়ে দাও তাতেও কোন পাপ নেই। আর আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখো যে, আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ অত্যন্ত ভাল করেই দেখেন। [ সুরা বাকারা ২:২৩৩ ]
এই আয়াতে মহান আল্লাহ পূর্ন দুই বছর শিশুকে বুকের দিধ দিতে বলেছেন। এবং যদি কোন কারনে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান মায়ের পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে প্রয়োজনে ধাত্রীর সহায়তা নিয়ে হলেও শিশুকে দুধ পান করাতে বলেছেন। আমাদের প্রিয় নবীজি (সাঃ) কিন্তু ধাত্রী বিবি হালিমার দুধ পান করেছিলেন।
এর পরের আয়াতটি হচ্ছে- সূরা লোকমানের ১৪নং আয়াত। এবং এখানেও শিশুকে দুই বছর বুকের দুধ খাওয়াতে বলা হয়েছে।
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ
আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের জোর নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো দু বছরে হয়। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে। [ সুরা লুকমান ৩১:১৪ ]
এরপর সূরা আহক্কাফের ১৫নং আয়াতে শিশুকে দুধ খাওয়ানোর কথা বলা হয়েছে।
بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِينَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টসহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য ছাড়তে লেগেছে ত্রিশ মাস। [ সুরা আহক্বাফ ৪৬:১৫ ]
মজার ব্যাপার হচ্ছে আগের দুটি আয়াতে শিশুকে দুই বছর দুধ দেবার ব্যাপারে বলা হয়েছে, কিন্তু সূরা আহক্কাফে গর্ভ ধারন আর স্তন্য দেবার ক্ষেত্রে সময়কে ৩০ মাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মহান আল্লাহ একটি উদ্ভুত বিষয় মানুষকে বলতে চেয়েছেন। কোরানের সূরা বাকারা আর সূরা লোকমান অনুযায়ী মা শিশুকে দুধ খাওয়াবে দুই বছর, অর্থাৎ ২৪ মাস। এ দুই আয়াতে কিন্তু গর্ভধারনের কথা বলা হয় নি। কিন্তু সুরা আহক্কাফে বলা হচ্ছে গর্ভধারন + স্তন্য প্রদান= ৩০ মাস। দুধ খাওয়াতে হবে ২৪ মাস। বাকি থাকল গর্ভে ধারন, ৩০-২৪=৬ মাস। তারমানে মা যদি ৬ মাস বয়সের প্রিম্যাচুউর শিশুও গর্ভে ধারন করে এবং জন্ম দেয় তাহলেও শিশুকে ২ বছর বা ২৪ মাস বুকের দুধ খাওয়াবে। আমরা জানি গর্ভের সন্তানের ৬ থেকে ৭ মাস বয়স হচ্ছে এজ অফ ভায়াবিলিটি। অর্থাৎ ৬ মাসের নীচে জন্ম নেয়া প্রিম্যাচুউর শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। কোরানে মহান আল্লাহ প্রিম্যাচুউর শিশুকেও বুকের দুধ দিতে বলেছেন।

সুরা তালাকের ৬নং আয়াত বলা হয়েছে-
أَسْكِنُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ سَكَنتُم مِّن وُجْدِكُمْ وَلَا تُضَارُّوهُنَّ لِتُضَيِّقُوا عَلَيْهِنَّ وَإِن كُنَّ أُولَاتِ حَمْلٍ فَأَنفِقُوا عَلَيْهِنَّ حَتَّى يَضَعْنَ حَمْلَهُنَّ فَإِنْ أَرْضَعْنَ لَكُمْ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ وَأْتَمِرُوا بَيْنَكُم بِمَعْرُوفٍ وَإِن تَعَاسَرْتُمْ فَسَتُرْضِعُ لَهُ أُخْرَى
তোমরা তোমাদের সামর্থ অনুযায়ী যেরূপ গৃহে বাস কর, তাদেরকেও বসবাসের জন্যে সেরূপ গৃহ দাও। তাদেরকে কষ্ট দিয়ে সংকটাপন্ন করো না। যদি তারা গর্ভবতী হয়, তবে সন্তানপ্রসব পর্যন্ত তাদের ব্যয়ভার বহন করবে। যদি তারা তোমাদের সন্তানদেরকে স্তন্যদান করে, তবে তাদেরকে প্রাপ্য পারিশ্রমিক দেবে এবং এ সম্পর্কে পরস্পর সংযতভাবে পরামর্শ করবে। তোমরা যদি পরস্পর জেদ কর, তবে অন্য নারী স্তন্যদান করবে। [ সুরা তালাক ৬৫:৬ ]
অর্থাৎ স্ত্রীকে তালাক দেবার পরও সন্তানের বাবার দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানের স্তন্যদানের ব্যাপারে দায়িত্ব নেয়া। মা দুধ খাওয়াতে না চাইলেও প্রয়োজনে অন্য নারীর সাহায্য নিয়ে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে হবে।
কোরানে কিভাবে বারবার মহান আল্লাহ শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন তা কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম। ১৪০০ বছর আগের কোন ধর্মগ্রন্থে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে উৎসাহিত করাটা অনন্য সাধারণ এবং মিরাকুলাস।